কক্সবাজারে তিন মৃত্যুর রহস্যের জট খোলেনি: আসামির ‘নাগাল পাচ্ছে না পুলিশ’

তুষার তুহিন •

স্ত্রী ও দুই শিশুর লাশ উদ্ধার ঘটনার তিন আসামি

দুই মেয়ে জাবিন (৫) ও জেরিন (২) এর লাশ পড়ে ছিল বিছানায়। মা জিশান আক্তারের (২৩) মৃতদেহ ঝুলছিল ফ্যানে। কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের উত্তর নাপিতখালী গ্রামে (নতুন অফিস) গত ২২ ডিসেম্বর এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার ১০ দিন পার হলে এর রহস্যজট খুলতে পারেনি পুলিশ। ধরতে পারেনি অভিযুক্তদের।

গত ২৫ ডিসেম্বর রাতে মৃত জিশানের মা মোহছেনা আক্তার বাদি হয়ে ঈদগাঁও থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন শহিদুল হক ও তার বড় ভাই জিয়াউল হক (৪০) এবং জিয়াউল হকের স্ত্রী লুৎফা আক্তার (৩০)। এরা মৃত দুই শিশুর বাবা ও চাচা-চাচি। ঘটনার দিন থেকে তারা পলাতক।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে জিশান আক্তারের সঙ্গে হত্যা মামলার প্রধান আসামি শহিদুল হকের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে যৌতুকের জন্য জিশানকে নির্যাতন করতো শ্বশুর বাড়ির লোকজন। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে অনেকবার সালিশি বৈঠক হয়েছে। এরপরও অত্যাচার থামেনি। গত দুই বছর আগে শহিদুল শ্বশুর বাড়ি থেকে ৩ লাখ টাকা ধার নেয়। যা এখনও পরিশোধ করেনি। উল্টো চলতি মাসে ২ লাখ টাকার জন্য জিশানকে মারধর করে।

এ বিষয়ে মামলার বাদি মোহছেনা আক্তার বলেন, শহিদুল আমাদের কাছ থেকে দুই বছর আগে ৩ লাখ টাকা ধার নেয়। এ নিয়ে কথাকাটাকাটি করে আমার মেয়ে এ বছরের শুরুতে বাড়ি চলে আসে। পরে স্থানীয়ভাবে সালিশ করে তাকে আবার শ্বশুর বাড়ি পাঠাই।

ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও সালিশে মীমাংসাকারী ঈদগাঁও ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি এনাম রনি বলেন, সাত মাস আগে জিশান বাবার বাড়ি চলে আসে। পরে বিষয়টি শহিদুল আমাকে জানায়। তখন আমি বিষয়টি সুরাহা করি। কথা ছিল চলতি বছরের লবণ মৌসুম শেষ হলে শহিদুল ওই তিন লাখ টাকা পরিশোধ করবে। এটা মেনে শহিদুল স্ত্রীকে নিয়ে যায়।

মৃত জিশানের বাবা নুরুল কবির বলেন, আগের টাকা পরিশোধ করা তো দূরের কথা, ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ থেকে কয়েকদফা ফোন করে উল্টো ২ লাখ টাকা চাচ্ছিল শহিদুল। আমার মেয়েকে মারধর করে তাকে দিয়েও ১৯ ডিসেম্বর আমাদের সঙ্গে কথা বলায় শহিদুল। কিন্তু সেদিন আমরা স্পষ্ট টাকা দিতে পারবো না বলে জানিয়ে দিয়েছিলাম। পরে শহিদুল ও তার পরিবারের লোকজন আমার মেয়েসহ দুই নাতিকে হত্যা করে পালিয়ে যায়।

এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঈদগাঁও থানার এসআই রেজাউল করিম বলেন, ‘এটি একটি স্পর্শকাতর মামলা। মৃতদেহ ময়নাতদন্ত রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত মৃত্যুর কারণ বলা যাচ্ছে না। তবে মৃত দুই শিশুর শরীর থেকে কিংবা মুখ থেকে আমরা বিষের গন্ধ পাইনি। ঝুলন্ত জিশানের মাথার পেছনে একটি আঘাতের চিহ্ন পেয়েছি।’
কার কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে খবর পেয়েছিলাম।’

এসআই রেজাউল করিম বলেন, ‘ঘটনার দিন থেকে মামলার অভিযুক্তরা পলাতক রয়েছে। তাদের মুঠোফোনও বন্ধ।’
বারবার যৌতুক দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, এজাহার অনুযায়ী ঘটনার কয়েকদিন আগে শহিদুল দুই লাখ টাকা দাবি করে শ্বশুর বাড়ির কাছে। বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ায় জানার জন্য আমরা কললিস্ট তোলার আবেদন করেছি।

এদিকে মামলার বাদি মোহছেনা আক্তার বলেন, ‘হত্যার দিন থেকেই পুলিশের আচরণ রহস্যজনক। তারা আমাদের প্রথমে প্ররোচনা মামলা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এছাড়া ঘটনার দিন মামলায় ৩ নম্বর আসামি লুৎফা ঘটনাস্থলে ছিলেন। কিন্তু

পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেনি। এসব কারণে মামলার পরবর্তী ধার্য তারিখ ১৮ জানুয়ারি আমরা মামলাটি অধিকতর ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য সিআইডি কিংবা পিবিআইকে দেওয়ার আবেদন করবো।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় বাদির এজাহার অনুযায়ী যেমন তদন্ত চলছে, তেমনি শিশুদের হত্যা করে মায়ের আত্মহত্যার বিষয়টিও প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা ঘটনাস্থল থেকে দেয়ালে লেখা একটি সুইসাইড নোট পাই । সেখানে লেখা ছিল ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। আমার মৃতদেহ দয়া করে পোস্টমর্টেম করবেন না ।’ কিন্তু এ লেখা জিশানের কিনা তাও পরীক্ষা করা হচ্ছে।

এএসপি বলেন, শিশু দুজনকে যে হত্যা করা হয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। তবে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে আসলেই জানতে পারবে ভিকটিম জিশান আত্মহত্যা করেছে নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে । এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে পুলিশ কাজ করছে।’